সমান্তরাল

সেলিম মোহাম্মেদ

খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ শেষে এক মগ চা নিয়ে বসার অভ্যাসটা অনেক দিনের, কিন্তু আজকের এই দিনটিতেই একটু ব্যতিক্রম হয়ে যায়। এই দিনটিতে চোখ খুলেই অর্ধাঙ্গিনীর শুভেচ্ছা পাই প্রথম, আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তারপর আমাদের আওয়াজ পেলে ছেলে মেয়েরা জেগে ওঠে একে একে, উদ্দেশ্য একটাই – কে সবার আগে তাদের বাবাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে! আমিও ব্যপারটাকে বেশ উপভোগ করি, আজ তাঁদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করার পর বেশ কিছু ফোন কল পেলাম,প্রভা কল করলেও নিশ্চয়ই জন্মদিন নিয়েই বেশ মজার একটা আড্ডা হবে! বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁর কলের জন্য।


⭐ জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা শুভ, বয়সটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে এবার?
⭐ তোমার নিজের বয়সটা দিয়ে আন্দাজ করে নিতে পারো, খুব একটা পার্থক্য হবেনা।
⭐ ও আচ্ছা তোমার সাথে আমাকেও বুড়ি বানাতে চাচ্ছো?
⭐ বন্ধু আমি চাইলেই কি আর তোমাকে খুকি কিংবা বুড়ি বানাতে পারবো? সময় তো তার আপন গতিতেই চলবে, তুমি আমি পড়ালেখা করেছি একই সাথে তাই বয়সটা কি আর খুব বেশি এদিক সেদিক হবে?
⭐ আরে ভাই আমাদের সময়ের মানুষের বয়সের হিসাবটা কি সঠিকভাবে লিখা হয়েছে সে সময়? তখন তো স্কুলের কেরানি সাহেব নিজেই পরীক্ষার আগে ঠিক করে দিতেন কার জন্মদিন কতো তারিখ হবে????।
⭐ কথাটা তুমি মন্দ বলোনি, তবে আমার জন্মস্থানের বদৌলতে আমরা একটা নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ চাইলেই আমাদের সঠিক জন্মদিনটা খুঁজে নিতে পারি, বিশেষ করে ১৯৬২ সনের পর আমাদের এলাকায় যাদের জন্ম হয়েছে।


⭐ সেটা আবার কেমন করে সম্ভব? জানি তোমার জন্ম হয়েছে মতলবে, আর তোমাদের মতলবের মানুষ একটু চাপাবজ হয়ে থাকে ???? জন্মদিন নিয়েও আবার চাপাবাজি করবে না তো?
⭐ তাহলে বলি, প্রথমেই জানিয়ে দিচ্ছি মতলবের মানুষ চাপাবজ নয়! মতলব লিখতে যেমন আকার ইকার লাগে না, কলম লিখতেও কিন্তু আকার ইকার লাগে না, তাই আমাদেরকে তুমি কলম’বাজ বলতে পারো চাপাবজ নয়! কারণ চাপাবজ আকার ছাড়া লিখা যায় না ????।


এবার বলি ওখানে ১৯৬২ সনের পর জন্ম নেয়া মানুষ কেনো তাঁদের সঠিক জন্ম তারিখটা খুঁজে নিতে পারে।
⭐ বলো,আজ তাহলে এটা নিয়েই গল্প করি!
⭐ হ্যা এটাও আমাদের ইতিহাসের একটি অংশ হতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই ICDDR’B চেনো?
⭐ হ্যা সেটা তো ঢাকা মহাখালীতে!
⭐ ঠিক বলেছো, তবে আমাদের মতলবেও একটি শাখা আছে। এই ICDDR’B শুরু হয় ১৯৬০ সনে মহাখালীতে,তখন তার নাম ছিল SEATO, অর্থাৎ South East Asia Treaty Organisation, তখন একটি ছোট ভাসমান জাহাজ নিয়ে দেশের বিভিন্ন যায়গায় তাঁরা কলেরার চিকিৎসা করাতে যেতো, কলেরা রোগটা ছিল তখন খুবই আতঙ্কের, এই রোগ কারো হলে মানুষ ঐ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতো। তাই এই জাহাজ কোথাও ভিড়াতে দিতো না এলাকার মানুষ খুব সহজেই।

১৯৬২/৬৩ এর দিকে এই জাহাজটি মতলব যায়। তখন সেখানে ছিল একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, তাঁর নাম ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী, তিনি ছিলেন তখন মতলব হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এই স্যারের শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকের ছাত্র ছিলেন আমার বাবা, আর আমি ছিলাম স্যারের শিক্ষকতা জীবনের প্রায় শেষের দিকের ছাত্র। সেই ওয়ালীউল্লাহ পাটোয়ারী স্যার তাঁর দূরদর্শী চিন্তা নিয়ে এই জাহাজটি স্যারের বাসার পেছনে খালের পাড়ে ভিড়তে দিয়ে চিকিৎসা সেবার সুযোগ করে দেন।

তারপর ধীরে ধীরে SEATO নাম পরিবর্তন করে সেই জায়গায় গড়ে উঠে ভুমিতে মোটামুটি বড় আকারে হাসপাতাল, যার নাম হয় CRL অর্থাৎ Cholera Research Laboratorie. তখন প্রতিদিন আসেপাশের গ্রামগুলোতে কয়েকজন নার্স এবং ডাক্তার যেতো প্রতিটি বাড়িতে। তাঁরা বিনা মূল্যে মানুষকে কলেরা এবং বিভিন্ন রোগের টিকা দিতো। প্রতিদিন নার্স গিয়ে একটি কার্ডে লিপিবদ্ধ করে আসতো, কার ঘরে শিশুর জন্ম হয়েছে কে মারা গিয়েছে, কার কলেরা হয়েছে কিংবা কাকে টিকা দেয়া হয়েছে আর কে বাকি আছে। তাই ১৯৬৩ পর থেকে ঐ এলাকায় যার জন্ম হয়েছে, তাঁরা চাইলেই তাঁদের সঠিক জন্ম তারিখটা খুঁজে নিতে পারে।


⭐ আচ্ছা – এটা সত্যিই আমার জানা ছিলো না। তাহলে সেই CRL থেকে এটা ICDDR’B হলো কবে?
⭐ এই হাসপাতালটি চলতো সম্পূর্ণ বিদেশি সাহায্যে,একটা সময় এর কাজের পরিধি আরো অনেক বেড়ে যায় এবং নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ICDDR অর্থাৎ International Centre For Diarrhoeal Disease ১৯৭৮ সনে জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় তখন সামান্য কিছু অংশীদারিত্ব নিয়ে এই ICDDR এর সাথে B যুক্ত করে দেয়, অর্থাৎ ICDDR হয়ে যায় ICDDR’B এখন এর পুরো নাম International Centre For Diarrhoeal Disease Of Bangladesh. আমার এই লেখার শেষে মতলবের সেই প্রথম জাহাজটির একটি ছবি দেবো তুমি দেখতে পারবে।

১৯৬২/১৯৬৩ সালে এই জাহাজটি নিয়ে মতলব কলেরা হাসপাতাল যাত্রা শুরু করে


⭐ সিত্যই চমৎকার কিছু কথা জানতে পারলাম, যা হয়তোবা আমার মতো অনেকেরই অজানা ছিলো।
⭐ বন্ধু এমন অনেক কিছু আমরা অনেকেই জানি না, কিন্তু বলতে গেলেই বিপদ।


⭐ হেই-হেই আজ কোন রাজনৈতিক কথা হবেনা, আজ আমি কল করেছি শুধু তোমার জন্মদিন উপলক্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। তবে যে তথ্যগুলো আজ জানলাম তাঁতে আমি হয়েছি সমৃদ্ধ।
⭐ যে তথ্যের কথা বললে, এই তথ্য সন্ত্রাসের কারণেই আমরা জাতিগত ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। যেহেতু তথ্যের কথাটা নিয়েই এলে, তাহলে আজ এই তথ্য নিয়ে একটা মজার গল্প দিয়েই শেষ করবো আজকের লেখা।


একজন আমেরিকান, একজন বৃটিশ আর একজন বাংলাদেশীর চাপাবাজি চলছিলো, সবাই ছিল বিশিষ্ট চাপাবজ। আমেরিকান ভদ্রলোক বললেন-আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত, একবার একটি বাচ্চা জন্ম নিয়েছিল দু’টো পা ছাড়া, তখন আমাদের চিকিৎকরা তাঁকে দু’টো কৃত্রিম পা লাগিয়ে দিয়েছিল, বড় হয়ে সে ছেলেটি অলিম্পিকে দৌড় প্রতিযোগিতায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবার বৃটিশ ভদ্রলোক বললেন, আমাদের দেশেও একটি বাচ্চা জন্মেছিল দু’টো হাত ছাড়া, তখন চিকিৎসকরা তাঁকে দু’টো কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দিলো, বড় হয়ে সে হয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাঁতারু।


এবার বাংলাদেশী ভদ্রলোক শুরু করলো, আমাদের দেশে একটি বাচ্চা জন্মেছিলো একদম মগজ ছাড়া, তখন চিকিৎসকরা তাঁর মগজের জায়গায় প্রচুর গোবর ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এখন সে আমাদের দেশের তথ্য মন্ত্রী ????????????????। চলবে, পর্ব -৬। চোখ রাখুন আগামী সপ্তাহে। সেলিম মোহাম্মেদ, লন্ডন, ইউ কে। ১৭ অক্টোবর ২০২৩.